মরিচ চাষে জমির প্রস্তুতি ও জাত নির্বাচন
Open Calculator
মরিচ চাষে জমির প্রস্তুতি ও জাত নির্বাচন
মরিচ বাংলাদেশে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় মসলা ফসল, যা খাদ্যে সুস্বাদু করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক দিক থেকেও লাভজনক। সফল মরিচ চাষের জন্য সঠিক জমি প্রস্তুতি এবং উপযুক্ত জাত নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেই:
জমি নির্বাচন
মরিচ চাষের জন্য সঠিক জমি নির্বাচন প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ:
- মাটির ধরন: দোঁআশ বা বেলে-দোঁআশ মাটি সবচেয়ে উপযুক্ত। এই মাটিতে পানি নিষ্কাশনের সুবিধা ভাল থাকে এবং শিকড়ের বিকাশ উত্তম হয়।
- জমির অবস্থান: জলাবদ্ধতামুক্ত উঁচু জমি বেছে নিতে হবে, কারণ মরিচ গাছের শিকড় জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
- সূর্যালোক: পর্যাপ্ত সূর্যালোক পায় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। দিনে অন্তত ৬-৮ ঘন্টা সূর্যালোক মরিচ গাছের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন।
- মাটির pH মাত্রা: মরিচ সাধারণত ৫.৫-৬.৮ pH মাত্রার মাটিতে ভাল জন্মে।
জমি প্রস্তুতি
মরিচ চাষের জন্য জমি প্রস্তুতি নিম্নলিখিত ধাপে করতে হবে:
১. প্রাথমিক চাষ ও আগাছা দমন:
- ৪-৫ বার গভীর চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করতে হবে।
- সকল আগাছা পরিষ্কার করে বের করে নিতে হবে।
- চাষের মাধ্যমে মাটিকে সম্পূর্ণ সূর্যালোকে উন্মুক্ত রাখতে হবে, এতে মাটিতে থাকা রোগজীবাণু ও কীটপতঙ্গের ডিম ধ্বংস হবে।
২. জৈব সার প্রয়োগ:
- প্রতি হেক্টর জমিতে ১০-১২ টন পচা গোবর বা কম্পোস্ট সার ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
- এটি মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং জৈব পদার্থের মাত্রা উন্নত করে।
৩. বেড তৈরী:
- ২০-৩০ সেমি উঁচু এবং ১-১.২ মিটার প্রস্থের বেড তৈরি করতে হবে।
- বেডের দৈর্ঘ্য জমির আকার অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে।
- দুই বেডের মাঝে ৩০-৪০ সেমি প্রশস্ত নালা রাখতে হবে, যা সেচ ও নিষ্কাশনের জন্য সহায়ক।
৪. রাসায়নিক সার প্রয়োগ:
- প্রতি হেক্টরে প্রায় ১৫০-২০০ কেজি TSP (ট্রিপল সুপার ফসফেট), ১৫০-২০০ কেজি MoP (মিউরেট অফ পটাশ) এবং ২০০-২৫০ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে।
- TSP ও MoP সম্পূর্ণ পরিমাণ শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে।
- ইউরিয়া তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে: ১/৩ অংশ রোপণের সময়, ১/৩ অংশ রোপণের ৩০ দিন পর, এবং বাকি ১/৩ অংশ ফুল আসার সময়।
৫. মাটি শোধন:
- রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণের জন্য চারা রোপণের আগে মাটি শোধন করতে হবে।
- ফরমালিন দ্রবণ (৪০% ফরমালিন ১ ভাগ + পানি ৪৯ ভাগ) প্রতি বর্গমিটারে ৫ লিটার হিসাবে প্রয়োগ করে প্লাস্টিক দিয়ে ৭ দিন ঢেকে রাখতে হবে।
- অথবা ট্রাইকোডারমা ভিরিডি জৈব ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে, যা পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ।
মরিচের জাত নির্বাচন
বাংলাদেশে মরিচের বিভিন্ন জাত চাষ করা হয়, যেগুলি মূলত দুই ধরনের:
১. দেশী জাত:
- বালুজাত: ফল ছোট, অত্যন্ত ঝাল, উচ্চ ফলন দেয়।
- বাগান-৩৫: মাঝারি আকারের, বাজারে চাহিদা ভাল।
- বারি মরিচ-১: ফলন ভাল, রোগ প্রতিরোধী, ৪-৫ মাস ধরে ফল দেয়।
- বারি মরিচ-২: শুকনা মরিচের জন্য উপযুক্ত, লম্বা (৬-৮ সেমি)।
- বারি মরিচ-৩: প্রতিকূল আবহাওয়া সহনশীল, হেক্টরে ১৪-১৬ টন ফলন দেয়।
২. হাইব্রিড জাত:
- রূপালি: অল্প সময়ে অধিক ফলন দেয়, মধ্যম আকারের লাল ফল।
- কোয়েস্ট F1: রোগ প্রতিরোধী, গাঢ় সবুজ থেকে লাল রঙের ফল।
- স্পাইস কিং: উচ্চ ফলনশীল, মোটা শাঁসযুক্ত, বাজারে ভাল দাম পাওয়া যায়।
- সুপার হট: অত্যন্ত ঝাল, রপ্তানির জন্য উপযুক্ত।
জাত নির্বাচনের বিবেচ্য বিষয়:
- চাষের উদ্দেশ্য: কাঁচা মরিচ বিক্রি করবেন নাকি শুকনা মরিচ উৎপাদন করবেন তা বিবেচনা করুন।
- ঝালের মাত্রা: বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ঝালের মাত্রা (ক্যাপসাইসিন) বিবেচনা করুন।
- ফলনের পরিমাণ: হাইব্রিড জাত সাধারণত বেশি ফলন দেয় কিন্তু বীজ সংরক্ষণ করা যায় না।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: এলাকায় সাধারণত কোন রোগ বেশি হয় তা বিবেচনা করে জাত বাছাই করুন।
- মৌসুম: খরিফ মৌসুমে (বর্ষাকাল) জলাবদ্ধতা সহনশীল জাত এবং রবি মৌসুমে (শীতকাল) শীত সহনশীল জাত বাছাই করুন।
মরিচ রোপণের সময়:
বাংলাদেশে সাধারণত দুই মৌসুমে মরিচ চাষ করা হয়:
- রবি মৌসুম: সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বীজ বপন করে নভেম্বর-ডিসেম্বরে চারা রোপণ করতে হয়।
- খরিফ মৌসুম: ফেব্রুয়ারি-মার্চে বীজ বপন করে এপ্রিল-মে মাসে চারা রোপণ করতে হয়।
উপসংহার
সফল মরিচ চাষের জন্য উপযুক্ত জমি নির্বাচন, সঠিক পদ্ধতিতে জমি প্রস্তুতি এবং এলাকা ও মৌসুম অনুযায়ী উপযুক্ত জাত নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটি মরিচ চাষের জন্য অত্যন্ত অনুকূল, তাই সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে আপনিও মরিচ চাষে সাফল্য পেতে পারেন। এছাড়া, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত জাত ব্যবহার করে অধিক ফলন নিশ্চিত করা সম্ভব।