মরিচ চাষে সার ব্যবস্থাপনা
মরিচ চাষে সার ব্যবস্থাপনা
মরিচ একটি গুরুত্বপূর্ণ মসলা ফসল যা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। একটি সফল মরিচ চাষের জন্য সঠিক সার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক পরিমাণে এবং সময়ে সার প্রয়োগ করলে মরিচের ফলন বাড়ে এবং গুণগত মান উন্নত হয়।
মরিচের সার চাহিদা বোঝা
মরিচ গাছ সাধারণত তিনটি প্রধান পুষ্টি উপাদান প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ করে: নাইট্রোজেন (N), ফসফরাস (P) এবং পটাশিয়াম (K)। এছাড়াও বিভিন্ন অণুপুষ্টি উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, জিংক, বোরন ইত্যাদি প্রয়োজন হয়।
মরিচ চাষে সার প্রয়োগের সময়সূচি
মরিচ চাষে সার প্রয়োগের একটি সাধারণ সময়সূচি নিম্নরূপ:
১. জমি তৈরির সময়:
- জৈব সার (গোবর/কম্পোস্ট): প্রতি হেক্টরে ১০-১২ টন
- টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট): সম্পূর্ণ পরিমাণ
- এমওপি (পটাশ): অর্ধেক পরিমাণ
- জিপসাম, জিংক, বোরন: সম্পূর্ণ পরিমাণ
২. চারা রোপণের সময়:
- ইউরিয়া: মোট পরিমাণের ১/৩ অংশ
৩. চারা রোপণের ৩০-৪০ দিন পর:
- ইউরিয়া: মোট পরিমাণের ১/৩ অংশ
- এমওপি: বাকি অর্ধেক পরিমাণ
৪. ফুল আসার সময় (রোপণের ৬০-৭০ দিন পর):
মরিচের জন্য সুপারিশকৃত সারের পরিমাণ
প্রতি হেক্টর জমির জন্য সুপারিশকৃত সারের পরিমাণ (মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে সমন্বয় করা উচিত):
সারের নাম
|
পরিমাণ (কেজি/হেক্টর)
|
ইউরিয়া
|
২৫০-৩০০
|
টিএসপি
|
১৫০-২০০
|
এমওপি
|
২০০-২৫০
|
জিপসাম
|
১০০-১৫০
|
জিংক সালফেট
|
১০-১২
|
বোরিক এসিড
|
১০-১২
|
জৈব সার
|
১০,০০০-১২,০০০
|
সার প্রয়োগের পদ্ধতি
১. মূল সার প্রয়োগ (জমি তৈরির সময়):
জমি চাষের সময় জৈব সার, টিএসপি, অর্ধেক এমওপি এবং সমস্ত অণুপুষ্টি জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। জৈব সার প্রয়োগ করা হলে মাটির গঠন উন্নত হয়, পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে এবং মাইক্রোবায়াল অ্যাকটিভিটি বৃদ্ধি পায়।
২. উপরি প্রয়োগ (টপ ড্রেসিং):
ইউরিয়া সার তিন ভাগে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম ভাগ চারা রোপণের সময়, দ্বিতীয় ভাগ ৩০-৪০ দিন পর এবং শেষ ভাগ ফুল আসার সময় প্রয়োগ করতে হবে। এমওপি সারের বাকি অংশ দ্বিতীয় কিস্তিতে দিতে হবে।
৩. সার প্রয়োগের কৌশল:
- গাছের গোড়া থেকে ৫-৭ সেমি দূরে মাটিতে সার প্রয়োগ করতে হবে
- সার দেওয়ার পর হালকা সেচ দিতে হবে
- সার দেওয়ার আগে মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা নিশ্চিত করুন
বিশেষ সার ব্যবস্থাপনা কৌশল
১. পাতায় সার ছিটানো (ফলিয়ার স্প্রে):
অণুপুষ্টি উপাদানের অভাব দেখা দিলে পাতায় স্প্রে করে সমাধান করা যেতে পারে:
- জিংকের অভাব: ০.২% জিংক সালফেট দ্রবণ
- বোরনের অভাব: ০.১-০.২% বোরিক এসিড দ্রবণ
- ক্যালসিয়ামের অভাব: ০.৫% ক্যালসিয়াম নাইট্রেট দ্রবণ
২. ফার্টিগেশন (সেচের সাথে সার প্রয়োগ):
ড্রিপ ইরিগেশন ব্যবস্থায় পানির সাথে দ্রবণীয় সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে সারের দক্ষতা বাড়ে এবং সার অপচয় কমে।
৩. জৈব সার ব্যবহার:
- কম্পোস্ট: প্রতি হেক্টরে ১০-১২ টন
- ভার্মিকম্পোস্ট: প্রতি হেক্টরে ৫-৬ টন
- নীমের খৈল: প্রতি হেক্টরে ১০০-১৫০ কেজি
মাটি পরীক্ষা ও সার সমন্বয়
সর্বোত্তম ফলাফলের জন্য, মরিচ চাষের আগে মাটি পরীক্ষা করা উচিত। মাটি পরীক্ষার ফলাফল অনুসারে সারের মাত্রা সমন্বয় করতে হবে। সাধারণত মরিচ পিএইচ ৬.০-৬.৮ মাত্রার মাটিতে ভালো জন্মে। অম্লীয় মাটিতে চুন প্রয়োগ করে পিএইচ সমন্বয় করা যেতে পারে।
সার ব্যবস্থাপনার সতর্কতা
- একসাথে বেশি পরিমাণে সার প্রয়োগ এড়িয়ে চলুন
- গাছের গোড়ায় সরাসরি সার প্রয়োগ করবেন না
- বৃষ্টির আগে বা পরে সার প্রয়োগ এড়ান
- রাসায়নিক সার ও জৈব সার একসাথে ব্যবহার করুন
- মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখুন সারের দক্ষতা বাড়াতে
সঠিক সার ব্যবস্থাপনা, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা এবং পরিবেশবান্ধব চাষাবাদের জন্য জৈব ও রাসায়নিক সারের সমন্বিত ব্যবহার সুপারিশ করা হয়। এটি টেকসই মরিচ উৎপাদন নিশ্চিত করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে মাটির উর্বরতা বজায় রাখবে।