মরিচ চাষে মরিচের ব্লাইট রোগ
Open Calculator
মরিচ চাষে মরিচের ব্লাইট রোগ
মরিচের ব্লাইট রোগ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে মরিচ চাষের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা। এই রোগ প্রধানত দুই প্রকারের: ১) আর্লি ব্লাইট (ফাইটোফথোরা প্যারাসিটিকা দ্বারা সৃষ্ট) এবং ২) লেট ব্লাইট (ফাইটোফথোরা ইনফেস্টান্স দ্বারা সৃষ্ট)। আসুন মরিচ চাষিদের জন্য মরিচের ব্লাইট রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করি।
রোগের লক্ষণ
আর্লি ব্লাইট এর লক্ষণ:
- চারা গাছের গোড়ায় কালো দাগ পড়ে এবং গাছ মারা যায়
- বয়স্ক গাছের পাতা, কাণ্ড এবং ফলে কালো দাগ দেখা যায়
- আক্রান্ত পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ে
- উচ্চ আর্দ্রতায় আক্রান্ত অংশে সাদা ছত্রাকের আবরণ দেখা যায়
লেট ব্লাইট এর লক্ষণ:
- পাতার কিনারায় হালকা সবুজ থেকে বাদামি রঙের দাগ
- আক্রান্ত অংশ ক্রমশ কালো হয়ে যায়
- পাতার নিচের দিকে সাদা ছত্রাকের আবরণ দেখা যায়
- আর্দ্র আবহাওয়ায় রোগ দ্রুত ছড়ায়
- ফলে কালো দাগ পড়ে এবং পচন শুরু হয়
রোগ ছড়ানোর কারণ
১. আবহাওয়াগত কারণ:
- উচ্চ আর্দ্রতা (৮০% এর বেশি)
- মাঝারি তাপমাত্রা (২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস)
- বৃষ্টি বা ভারী শিশির
- ঘন কুয়াশা
২. চাষাবাদের সমস্যা:
- গাছের মধ্যে কম বায়ু চলাচল
- অতিরিক্ত ঘন করে চারা রোপণ
- দূষিত বীজ ব্যবহার
- আক্রান্ত গাছের অবশিষ্টাংশ জমিতে রাখা
- অত্যধিক নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
১. বীজ ও চারা নির্বাচন:
- রোগমুক্ত বীজ বা চারা ব্যবহার করুন
- রোগ প্রতিরোধী জাত নির্বাচন করুন (যেমন: BARI মরিচ-১, BARI মরিচ-৩)
২. জমি প্রস্তুতি ও চাষাবাদ:
- জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখুন
- সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ করুন (সারিতে ৬০ সেমি এবং চারায় চারায় ৪৫-৫০ সেমি)
- ফসল পর্যায়ক্রম অনুসরণ করুন (৩-৪ বছর পর একই জমিতে মরিচ চাষ করুন)
- সুষম সার প্রয়োগ করুন, অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার এড়িয়ে চলুন
৩. স্বাস্থ্যসম্মত চাষাবাদ:
- নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করুন
- আক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে ধ্বংস করুন (পুড়িয়ে ফেলুন)
- গাছের গোড়ায় পানি সেচ দিন, পাতায় নয়
রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা:
১. জৈবিক নিয়ন্ত্রণ:
- ট্রাইকোডার্মা হারজিয়ানাম ছত্রাক ব্যবহার করুন
- নিম তেল স্প্রে (৫ মিলি/লিটার পানিতে)
- রসুন নিষ্কাশন স্প্রে (১০০ গ্রাম রসুন + ১ লিটার পানি)
২. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ:
- কপার অক্সিক্লোরাইড (০.৩%) স্প্রে
- ম্যানকোজেব (০.২%) স্প্রে
- মেটালাক্সিল + ম্যানকোজেব (রিডোমিল গোল্ড) ২ গ্রাম/লিটার পানিতে
- ডাইমেথোমর্ফ + ম্যানকোজেব (একোরড এম জেড) ২ গ্রাম/লিটার পানিতে
৩. স্প্রে সময়সূচি:
- রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথেই স্প্রে শুরু করুন
- ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করুন
- বৃষ্টির পর অবশ্যই পুনরায় স্প্রে করুন
- ছত্রাকনাশক প্রয়োগের সময় ঘন কুয়াশা বা বৃষ্টি এড়িয়ে চলুন
সমন্বিত রোগ ব্যবস্থাপনা (IPM)
সর্বোত্তম ফলাফলের জন্য নিম্নলিখিত সমন্বিত পদ্ধতি অনুসরণ করুন:
১. প্রাথমিক পর্যায়ে:
- রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার
- মাটি শোধন (ট্রাইকোডার্মা দিয়ে)
- সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ
২. মধ্যবর্তী পর্যায়ে:
- নিয়মিত পর্যবেক্ষণ
- আক্রান্ত পাতা ও ডাল অপসারণ
- জৈবিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োগ
৩. তীব্র আক্রমণে:
- রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োগ
- ছত্রাকনাশক পরিবর্তন করে প্রয়োগ (রেজিস্টেন্স এড়াতে)
মরিচের ব্লাইট রোগ প্রতিরোধে একটি সফল চাষি সবসময় সতর্ক থাকেন এবং সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেন। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই রোগ সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।