মরিচ চাষে হোয়াইট মোল্ড রোগ কারণ, লক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
Open Calculator
মরিচ চাষে হোয়াইট মোল্ড রোগ: কারণ, লক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
মরিচ চাষে হোয়াইট মোল্ড একটি গুরুতর ছত্রাকজনিত রোগ যা বিশেষ করে উচ্চ আর্দ্রতা এবং ঠান্ডা আবহাওয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আসুন এই রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।
রোগের কারণ
হোয়াইট মোল্ড রোগ মূলত স্ক্লেরোটিনিয়া স্ক্লেরোশিওরাম (Sclerotinia sclerotiorum) নামক একটি ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট হয়। এছাড়াও স্ক্লেরোটিনিয়া মাইনর (Sclerotinia minor) এবং কিছু ক্ষেত্রে বোট্রাইটিস সিনেরিয়া (Botrytis cinerea) নামক ছত্রাকও এই রোগের জন্য দায়ী হতে পারে।
রোগের লক্ষণসমূহ
মরিচের হোয়াইট মোল্ড রোগের প্রধান লক্ষণগুলি হল:
১. কাণ্ডে সাদা তুলার মতো আবরণ: গাছের কাণ্ডে সাদা তুলোর মতো ছত্রাকের উপস্থিতি দেখা যায়, যা ক্রমশ ঘন হয়ে ওঠে।
২. কাণ্ডের গোড়ায় পচন: প্রথমে গাছের গোড়ার অংশে পানি-ভেজা পচন দেখা যায়, যা পরে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে সমগ্র কাণ্ড জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
৩. স্ক্লেরোটিয়া গঠন: রোগের অগ্রগতির সাথে সাথে, কালো বা গাঢ় বাদামী রঙের কঠিন দানা (স্ক্লেরোটিয়া) গঠিত হয়, যা মাটিতে পড়ে পরবর্তী মৌসুমে সংক্রমণের উৎস হিসেবে কাজ করে।
৪. পাতা এবং ফলের ক্ষতি: আক্রান্ত গাছের পাতা হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়, এবং ফলগুলিতেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে সেগুলি পচে যায়।
৫. গাছের মৃত্যু: গুরুতর আক্রমণে সম্পূর্ণ গাছটি শুকিয়ে মারা যেতে পারে।
অনুকূল পরিবেশ
হোয়াইট মোল্ড রোগ বিকাশের জন্য নিম্নলিখিত পরিবেশগত অবস্থা অনুকূল:
- ১৫-২৫°C তাপমাত্রা
- ৮০% এর অধিক আপেক্ষিক আর্দ্রতা
- জলাবদ্ধতা বা অতিরিক্ত সেচ
- ঘন বসানো গাছপালা (যেখানে বাতাস চলাচল কম)
- পূর্ববর্তী ফসলে আক্রান্ত অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি
রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়
হোয়াইট মোল্ড রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য সমন্বিত পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত:
১. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
- শস্য পর্যায়ক্রম: একই জমিতে পরপর ৩-৪ বছর মরিচ বা অন্যান্য সংবেদনশীল ফসল (টমেটো, বেগুন ইত্যাদি) চাষ করা থেকে বিরত থাকা।
- সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ: গাছের মধ্যে পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রাখা, যাতে বাতাস চলাচল করতে পারে এবং আর্দ্রতা কম থাকে।
- নিষ্কাশন ব্যবস্থা: জমিতে যাতে জলাবদ্ধতা না হয় সেজন্য উন্নত নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
- রোগমুক্ত বীজ ও চারা: সর্বদা রোগমুক্ত উৎস থেকে বীজ ও চারা সংগ্রহ করা।
২. কৃষি পদ্ধতি:
- মাল্চিং: পলিথিন দিয়ে মাল্চিং করলে মাটি থেকে ছত্রাকের সংক্রমণ কমানো যায়।
- সতর্ক সেচ প্রয়োগ: গাছের গোড়ায় সরাসরি পানি না দিয়ে ড্রিপ ইরিগেশন বা অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করা।
- আক্রান্ত গাছ অপসারণ: রোগাক্রান্ত গাছ দেখামাত্র তুলে পুড়িয়ে ফেলা, মাটিতে না রাখা।
৩. জৈবিক নিয়ন্ত্রণ:
- ট্রাইকোডার্মা হারজিয়ানাম: এই উপকারী ছত্রাক মাটিতে প্রয়োগ করলে রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
- সুডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স: এই ব্যাকটেরিয়া মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং রোগজীবাণু নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
৪. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ:
যদি রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়, নিম্নলিখিত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে:
- কার্বেন্ডাজিম (৫০% WP) - ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে
- ক্লোরোথালোনিল (৭৫% WP) - ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে
- ম্যানকোজেব (৭৫% WP) - ২.৫ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে
- ফ্লুডিওক্সোনিল বা ফেনহেক্সামিড ভিত্তিক ছত্রাকনাশক
ছত্রাকনাশক প্রয়োগের সময় রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথেই স্প্রে করা উচিত এবং ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার প্রয়োগ করা উচিত।
বিশেষ সতর্কতা
- ছত্রাকনাশক ব্যবহারের সময় সুরক্ষা পোশাক ও মুখোশ পরিধান করুন।
- আক্রান্ত অবশিষ্টাংশ জমিতে রাখবেন না, পুড়িয়ে ফেলুন।
- সময়মত রোগের লক্ষণ সনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিন।
- মাটির অম্লতা (pH) ৬.০-৬.৫ এর মধ্যে বজায় রাখুন, যা এই রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
মরিচে হোয়াইট মোল্ড রোগ যদিও চ্যালেঞ্জিং, তবে উপযুক্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, সঠিক আবাদ পদ্ধতি এবং সময়মত রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এটি সফলভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব। রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখামাত্র দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া এবং সমন্বিত রোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অবলম্বন করাই এই রোগ নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি।