সরিষা চাষে পোকা মাকড়ের আক্রমণ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়
Open Calculator
সরিষা চাষে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়
সরিষা বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান তৈলবীজ ফসল, যা দেশে তেলের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০২৪-২০২৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৪.৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয় এবং বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৫.২ লক্ষ মেট্রিক টন। তবে সরিষা চাষে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ অন্যতম প্রধান সমস্যা, যা ফলনের মান ও পরিমাণ উভয়ই কমিয়ে দেয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পোকা-মাকড়ের আক্রমণে বাংলাদেশে সরিষার ফলন প্রায় ২৫-৩০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
এই নিবন্ধে আমরা সরিষা চাষে সাধারণত কোন কোন পোকা-মাকড়ের আক্রমণ হয় এবং সেগুলি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উপায়গুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
সরিষা ফসলের প্রধান ক্ষতিকারক পোকা-মাকড়
১. জাব পোকা (Aphids)
বৈজ্ঞানিক নাম: Lipaphis erysimi
আক্রমণের লক্ষণ:
- পাতা, কাণ্ড, ফুল ও ফলের রস চুষে খায়
- আক্রান্ত পাতা কুঁকড়ে যায় ও হলুদ হয়ে যায়
- গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়
- গাছে কালো ছত্রাকের আক্রমণ (সুটি মোল্ড) দেখা যায়
- আক্রমণ বেশি হলে ফুল ও ফল ধারণ কমে যায়
ক্ষতির পরিমাণ: গবেষণায় দেখা গেছে, জাব পোকার আক্রমণে সরিষার ফলন ৪৫% পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
২. সাধারণ মাছি পোকা (Sawfly)
বৈজ্ঞানিক নাম: Athalia lugens proxima
আক্রমণের লক্ষণ:
- লার্ভা পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে
- শুধু পাতার শিরাগুলো থেকে যায়
- গুরুতর আক্রমণে পুরো গাছ কাঠির মত হয়ে যায়
- আক্রমণ বেশি হলে পুরো ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে
ক্ষতির পরিমাণ: তীব্র আক্রমণে ৩০-৪০% ফলন কমতে পারে।
৩. সাধারণ পাতা সুরঙ্গকারী (Leaf Miner)
বৈজ্ঞানিক নাম: Chromatomyia horticola
আক্রমণের লক্ষণ:
- পাতার ভিতরে সুরঙ্গ তৈরি করে
- পাতায় সাদা আঁকাবাঁকা লাইন দেখা যায়
- পাতার সালোকসংশ্লেষণ ক্ষমতা কমে যায়
- আক্রমণ বেশি হলে পাতা শুকিয়ে যায়
ক্ষতির পরিমাণ: গড়ে ১০-১৫% ফলন হ্রাস পায়।
৪. পাতা খেকো লেদা পোকা (Leaf Webber)
বৈজ্ঞানিক নাম: Crocidolomia binotalis
আক্রমণের লক্ষণ:
- লার্ভা পাতা একসাথে জড়িয়ে রাখে
- জাল দিয়ে আবৃত করে পাতা খায়
- বাড়ন্ত পর্যায়ে গাছের আগার অংশ খেয়ে ফেলে
- ফুল ও ফল ক্ষতিগ্রস্ত করে
ক্ষতির পরিমাণ: আক্রমণের তীব্রতার উপর নির্ভর করে ২০-৩০% ফলন কমতে পারে।
৫. সরিষার ফুল মাছি (Mustard Flower Fly)
বৈজ্ঞানিক নাম: Delia florilega
আক্রমণের লক্ষণ:
- ফুলের কোরক ও ফুল নষ্ট করে
- আক্রান্ত ফুল ঝরে পড়ে
- ফলন উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়
ক্ষতির পরিমাণ: গবেষণায় দেখা গেছে, ফুল মাছির আক্রমণে ফলন ২৫-৩৫% কমতে পারে।
৬. থ্রিপস (Thrips)
বৈজ্ঞানিক নাম: Thrips tabaci
আক্রমণের লক্ষণ:
- পাতা, ফুল ও ফলের রস চুষে খায়
- পাতায় রূপালী বা সাদাটে দাগ দেখা যায়
- আক্রান্ত পাতা কুঁকড়ে যায়
- ফুল ঝরে যায় ও ফল বিকৃত হয়
ক্ষতির পরিমাণ: মাঝারি থেকে তীব্র আক্রমণে ১৫-২০% ফলন কমতে পারে।
৭. সাদা মাছি (Whitefly)
বৈজ্ঞানিক নাম: Bemisia tabaci
আক্রমণের লক্ষণ:
- পাতার নিচের দিকে থেকে রস চুষে খায়
- পাতা হলুদ হয়ে যায়
- গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়
- কালো ছত্রাকের আক্রমণ (সুটি মোল্ড) দেখা যায়
ক্ষতির পরিমাণ: সাদা মাছির আক্রমণে ১৫-২৫% ফলন কমতে পারে।
৮. সরিষার শুয়া পোকা (Mustard Caterpillar)
বৈজ্ঞানিক নাম: Plutella xylostella
আক্রমণের লক্ষণ:
- পাতা ছিদ্র করে খায়
- মাঝে মাঝে ফুল ও শুটি ক্ষতিগ্রস্ত করে
- তীব্র আক্রমণে শুধু পাতার শিরা থেকে যায়
ক্ষতির পরিমাণ: গুরুতর আক্রমণে ২০-৩০% ফলন কমতে পারে।
৯. মাইট বা মাকড় (Mites)
বৈজ্ঞানিক নাম: Tetranychus urticae
আক্রমণের লক্ষণ:
- পাতার রস চুষে খায়
- পাতায় হলুদ বা বাদামী দাগ দেখা যায়
- পাতা শুকিয়ে যায়
- গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়
ক্ষতির পরিমাণ: আক্রমণের তীব্রতা অনুযায়ী ১০-২০% ফলন কমতে পারে।
পোকা-মাকড় নিয়ন্ত্রণের উপায়
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
1.চাষাবাদ সংক্রান্ত ব্যবস্থা:
- সঠিক সময়ে বীজ বপন করুন (কার্তিক মাসের ১-১৫ তারিখের মধ্যে)
- সুস্থ-সবল বীজ ব্যবহার করুন
- ফসল পর্যায়ক্রম অনুসরণ করুন (৩-৪ বছরে একবার একই জমিতে সরিষা চাষ করুন)
- জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন
- আগাছা নিয়ন্ত্রণ করুন
2. রোগ ও পোকা প্রতিরোধী জাত ব্যবহার:
- বারি সরিষা-১৪ (পোকা প্রতিরোধী)
- বারি সরিষা-১৭ (জাব পোকা প্রতিরোধী)
- বারি সরিষা-১৮ (বিভিন্ন পোকা প্রতিরোধী)
3. পানি সেচ ব্যবস্থাপনা:
- সময়মত সেচ দিন
- অতিরিক্ত আর্দ্রতা এড়ান
4. সার ব্যবস্থাপনা:
- সুষম সার প্রয়োগ করুন
- অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার ব্যবহার এড়ান
জৈবিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
1. প্রাকৃতিক শত্রু সংরক্ষণ:
- লেডিবার্ড বিটল (Coccinellidae)
- সিরফিড ফ্লাই (Syrphidae)
- প্যারাসাইটিক ওয়াস্প (Braconidae)
- প্রেডাটরি মাইট
2. জৈব বালাইনাশক:
- নিম তেল (৫ মিলি/লিটার পানিতে)
- নিম বীজের নির্যাস (৫০ গ্রাম/লিটার পানিতে)
- তুলসী পাতার নির্যাস (১:৪ অনুপাতে)
- বিষকাটালির পাতার নির্যাস
- ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস (Bt) ভিত্তিক কীটনাশক (১-২ গ্রাম/লিটার)
3. আলো ফাঁদ:
- প্রতি হেক্টরে ১০-১২টি আলো ফাঁদ স্থাপন করুন
- সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত জ্বালিয়ে রাখুন
4. হলুদ আঠালো ফাঁদ:
- প্রতি হেক্টরে ৪০-৫০টি হলুদ আঠালো ফাঁদ স্থাপন করুন
- থ্রিপস, সাদা মাছি ও জাব পোকা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর
রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
সতর্কতা: রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের আগে অবশ্যই পরামর্শ নিন এবং সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
1. জাব পোকা নিয়ন্ত্রণে:
- ইমিডাক্লোপ্রিড (১ মিলি/লিটার পানিতে)
- ডাইমেথোয়েট (২ মিলি/লিটার পানিতে)
- থায়ামেথক্সাম (০.৫ গ্রাম/লিটার পানিতে)
2. সাধারণ মাছি পোকা নিয়ন্ত্রণে:
- ক্লোরপাইরিফস (২ মিলি/লিটার পানিতে)
- সাইপারমেথ্রিন (১ মিলি/লিটার পানিতে)
- মালাথিয়ন (২ মিলি/লিটার পানিতে)
3. পাতা খেকো লেদা পোকা নিয়ন্ত্রণে:
- ক্লোরান্ট্রানিলিপ্রোল (০.৫ মিলি/লিটার পানিতে)
- ইমামেকটিন বেনজোয়েট (১ গ্রাম/লিটার পানিতে)
4. থ্রিপস ও সাদা মাছি নিয়ন্ত্রণে:
- ফিপ্রোনিল (১ মিলি/লিটার পানিতে)
- স্পিনোস্যাড (০.৪ মিলি/লিটার পানিতে)
5. মাইট বা মাকড় নিয়ন্ত্রণে:
- প্রোপারগাইট (২ মিলি/লিটার পানিতে)
- হেক্সাথিয়াজক্স (১ মিলি/লিটার পানিতে)
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM)
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা হল পোকা-মাকড় নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি, যাতে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সমন্বিত ভাবে ব্যবহার করা হয়:
1.IPM এর মূল উপাদান:
- নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ
- প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
- পোকার অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ
- জৈবিক নিয়ন্ত্রণ
- যথাসম্ভব কম রাসায়নিক ব্যবহার
2. বাস্তবায়নের পদ্ধতি:
- সপ্তাহে অন্তত একবার জমি পরিদর্শন করুন
- পোকা-মাকড়ের সংখ্যা গণনা করুন
- অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রা ছাড়ানোর আগে ব্যবস্থা নিন
- প্রথমে জৈবিক পদ্ধতি প্রয়োগ করুন
- প্রয়োজনে শেষ উপায় হিসেবে রাসায়নিক ব্যবহার করুন
3. জাব পোকার জন্য IPM:
- পর্যবেক্ষণ: প্রতি গাছে ৫০+ জাব থাকলে ব্যবস্থা নিন
- নিম তেল স্প্রে করুন
- প্রাকৃতিক শত্রু রক্ষা করুন
- নিয়ন্ত্রণে না আসলে নির্দিষ্ট কীটনাশক প্রয়োগ করুন
4. সাধারণ মাছি পোকার জন্য IPM:
- পর্যবেক্ষণ: প্রতি গাছে ১-২টি লার্ভা থাকলে ব্যবস্থা নিন
- হাত দিয়ে পোকা সংগ্রহ করে ধ্বংস করুন
- নিম বা তুলসীর নির্যাস স্প্রে করুন
- প্রয়োজনে কীটনাশক ব্যবহার করুন
বিশেষ দ্রষ্টব্য
- সবসময় সঠিক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করুন
- কীটনাশক স্প্রে করার সময় সুরক্ষা পোশাক পরুন
- ফুল আসা অবস্থায় যথাসম্ভব কীটনাশক ব্যবহার এড়িয়ে চলুন
- রাসায়নিক কীটনাশক স্প্রে করার পর কমপক্ষে ১৫ দিন অপেক্ষা করুন, তারপর ফসল সংগ্রহ করুন
- একই ধরনের কীটনাশক বার বার ব্যবহার করবেন না, এতে পোকা-মাকড়ের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়
- প্রাকৃতিক শত্রু সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দিন
উপসংহার
সরিষা চাষে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ একটি বড় সমস্যা, তবে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই সমস্যা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। চাষাবাদ পদ্ধতি, জৈবিক নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে রাসায়নিক ব্যবস্থা সমন্বিত করে সফলভাবে সরিষা চাষ করা যায়। বিশেষ করে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) পদ্ধতি অনুসরণ করলে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কমিয়ে অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব। সবশেষে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে টেকসই সরিষা চাষের প্রতি সচেতন থাকা প্রয়োজন।
প্রশ্নোত্তর বিভাগ
সরিষা ফসলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি কোন পোকা করে?
জাব পোকা সরিষা ফসলের সবচেয়ে ক্ষতিকারক পোকা। এটি ফসলের ৪৫% পর্যন্ত ক্ষতি করতে পারে।
কোন সময়ে সরিষায় পোকার আক্রমণ বেশি হয়?
সাধারণত ফুল আসার সময় ও ফুল থেকে ফল ধারণের সময় পোকার আক্রমণ বেশি হয়।
জৈবিক উপায়ে জাব পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিভাবে?
নিম তেল (৫ মিলি/লিটার পানিতে) স্প্রে করে, বা লেডিবার্ড বিটল ও সিরফিড ফ্লাই সংরক্ষণ করে জৈবিক উপায়ে জাব পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
পোকা-মাকড় নিয়ন্ত্রণে আলো ফাঁদ কীভাবে কাজ করে?
আলো ফাঁদে পতঙ্গরা আকৃষ্ট হয় এবং ফাঁদে আটকে যায়। এটি প্রধানত রাতে সক্রিয় পোকা-মাকড় যেমন মথ জাতীয় পোকা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) কী?
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা হলো পোকা-মাকড় নিয়ন্ত্রণের এমন একটি পদ্ধতি যেখানে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ কৌশল (জৈবিক, যান্ত্রিক, রাসায়নিক) সমন্বিত ভাবে ব্যবহার করে পোকা-মাকড়কে অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রার নীচে রাখা হয়, পরিবেশের ক্ষতি কম করে।