সরিষার ডাউনি মিলডিউ রোগ লক্ষণ ও প্রতিকার
সরিষার ডাউনি মিলডিউ রোগ: লক্ষণ ও প্রতিকার
ডাউনি মিলডিউ সরিষা ফসলের একটি প্রধান ফাঙ্গাল রোগ যা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরিষা উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই রোগ Hyaloperonospora brassicae (পূর্বে Peronospora parasitica নামে পরিচিত) নামক ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট হয়।
রোগের সময়কাল
ডাউনি মিলডিউ সাধারণত নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে দেখা যায়:
- মৌসুম: প্রধানত শীতকালে (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি)
- তাপমাত্রা: 10-20°C (সর্বোত্তম 15-18°C)
- আর্দ্রতা: 85% বা তার বেশি আপেক্ষিক আর্দ্রতা
- প্রচুর শিশির: সকালের দিকে ঘন কুয়াশা বা শিশিরযুক্ত সময়
- মেঘলা আবহাওয়া: যখন সূর্যের আলো কম থাকে
বাংলাদেশে সরিষার ফসল যখন 30-45 দিন বয়সী হয় (ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে) তখন এই রোগের আক্রমণ বেশি দেখা যায়।
রোগের লক্ষণ
সরিষা গাছে ডাউনি মিলডিউ রোগের লক্ষণগুলি হল:
পাতায় লক্ষণ
- প্রাথমিক অবস্থায়: পাতার উপরিভাগে হলুদ-সবুজ বা হালকা সবুজ রঙের অনিয়মিত দাগ দেখা যায়
- পাতার নিচের দিকে: ধূসর-বাদামি বা বেগুনি ছত্রাকের আবরণ (স্পোরাঞ্জিয়া)
- পরবর্তী অবস্থায়: আক্রান্ত অংশ বাদামি হয়ে শুকিয়ে যায় ও পাতা ঝরে যেতে পারে
কাণ্ডে লক্ষণ
- কাণ্ডে লম্বা বাদামি দাগ দেখা যায়
- আক্রান্ত কাণ্ড বিকৃত হয়ে বেঁকে যেতে পারে
- মারাত্মক আক্রমণে কাণ্ড ফেটে যায়
ফুল ও শুটিতে লক্ষণ
- ফুল ছোট ও বিকৃত হয়
- শুটি সঠিকভাবে বিকশিত হয় না
- বীজ ছোট ও অপুষ্ট হয়
ক্ষতির মাত্রা
- মাঝারি আক্রমণে ফলন 20-30% কমে যেতে পারে
- মারাত্মক আক্রমণে ফলন 50-70% পর্যন্ত কমতে পারে
- আক্রমণ শুরুর 3-4 সপ্তাহের মধ্যে সঠিক ব্যবস্থা না নিলে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়
প্রতিকার ব্যবস্থা
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
- রোগ প্রতিরোধী জাত: বাংলাদেশে BARI সরিষা-11, BARI সরিষা-16 ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করা
- বীজ শোধন: প্রতি কেজি বীজে 2 গ্রাম ভিটাভেক্স-200/প্রোভেক্স/ক্যাপটান দিয়ে শোধন করে বপন করা
- পর্যাপ্ত দূরত্ব: সরিষার গাছ থেকে গাছের মধ্যে পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রাখা (30 সেমি × 10 সেমি)
- সময়মত বপন: অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বপন করা
- পানি নিষ্কাশন: জমিতে পানি জমে থাকলে তা দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা
- ফসল পর্যায়ক্রম: একই জমিতে বার বার সরিষা চাষ না করে 3-4 বছর পর পর সরিষা চাষ করা
রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ
রোগের লক্ষণ দেখা যাওয়ার সাথে সাথে নিম্নলিখিত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে:
- রিডোমিল গোল্ড (Metalaxyl 8% + Mancozeb 64%): প্রতি লিটার পানিতে 2 গ্রাম হারে 7-10 দিন অন্তর 2-3 বার স্প্রে করতে হবে
- রোভরাল (Iprodione 50% WP): প্রতি লিটার পানিতে 2 গ্রাম হারে স্প্রে করা
- সেকটিন (Fenamidone 10% + Mancozeb 50% WG): প্রতি লিটার পানিতে 1.5 গ্রাম হারে স্প্রে করা
- ডাইথেন এম-45 (Mancozeb 80% WP): প্রতি লিটার পানিতে 2 গ্রাম হারে স্প্রে করা
- বর্দোমিশ্রণ: 1% বর্দোমিশ্রণ (1:1:100) স্প্রে করা
জৈবিক নিয়ন্ত্রণ
- নিমের সার: 5 কেজি নিমের খৈল বা 20 লিটার নিমের পানি প্রতি শতকে প্রয়োগ করা
- ট্রাইকোডার্মা: 5 গ্রাম ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা
- গরম পানি: গরম পানি (50°C) দিয়ে বীজ শোধন করে রোগ প্রতিরোধ করা যায়
বিশেষ সতর্কতা
- ছত্রাকনাশক স্প্রে করার সময় পাতার উপরের ও নিচের উভয় পৃষ্ঠ ভালভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে
- স্প্রে করার সময় মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস পরিধান করতে হবে
- বৃষ্টির পর অবশ্যই পুনরায় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে
- রোগ দেখা যাওয়ার সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিতে হবে, দেরি করলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে
সময়মত ও সঠিকভাবে এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করলে সরিষার ডাউনি মিলডিউ রোগ নিয়ন্ত্রণ করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।