সরিষার পাউডারি মিলডিউ রোগ লক্ষণ ও প্রতিকার
Open Calculator
সরিষার পাউডারি মিলডিউ রোগ: লক্ষণ ও প্রতিকার
সরিষার পাউডারি মিলডিউ একটি ছত্রাকজনিত রোগ, যা বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের সরিষা চাষে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি সাধন করে। এই রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা এবং সময়মত প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রোগের কারণ
পাউডারি মিলডিউ রোগ Erysiphe cruciferarum নামক ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট। এই ছত্রাক বাতাসের মাধ্যমে এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়িয়ে পড়ে।
সময়কাল
সাধারণত এই রোগ নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে দেখা দেয়:
- শীতকালে (ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে) যখন তাপমাত্রা ১৫-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে
- বাতাসে আর্দ্রতা ৭০-৮০% এর বেশি থাকলে
- সকাল বেলায় কুয়াশা ও শিশির থাকলে
- দিনের বেলা ঠান্ডা ও রাতে আর্দ্র পরিবেশ হলে
রোগের লক্ষণসমূহ
১. প্রাথমিক লক্ষণ: প্রথমে পাতার উপরিভাগে গোলাকার সাদা ধূলিকণার মতো দাগ দেখা যায়।
২. পরবর্তী লক্ষণ:
- দাগগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে একত্রিত হয়ে যায়
- পাতা, কাণ্ড, ফুল ও ফলে সাদা পাউডারের মতো আস্তরণ পড়ে
- আক্রান্ত অংশগুলো হলুদ এবং পরে বাদামি রঙ ধারণ করে
- পাতা শুকিয়ে যায় এবং সময়ের সাথে ঝরে পড়ে
৩. উন্নত পর্যায়ে:
- আক্রান্ত গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়
- ফুল ও ফল উৎপাদন কমে যায়
- বীজের আকার ছোট হয় এবং তেলের পরিমাণ কমে যায়
প্রতিকার ব্যবস্থা
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
১. রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার: BARI সরিষা-১১, BARI সরিষা-১৬ ইত্যাদি পাউডারি মিলডিউ রোগ প্রতিরোধী জাত।
২. চাষ পদ্ধতি:
- সঠিক সময়ে (অক্টোবর-নভেম্বর) বীজ বপন করা
- সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১০ সেমি রাখা
- সুষম সার প্রয়োগ করা, বিশেষ করে পটাশ সার
৩. ফসল চক্র অনুসরণ: একই জমিতে পরপর ৩-৪ বছর সরিষা চাষ না করে অন্য ফসল (যেমন: ধান, গম, ভুট্টা) চাষ করা।
৪. স্বাস্থ্যসম্মত বীজ ব্যবহার: রোগমুক্ত, প্রত্যয়িত বীজ ব্যবহার করা।
রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ
১. রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে:
- সালফার ভিত্তিক ছত্রাকনাশক যেমন: সালফেক্স/কুমুলাস/থিওভিট (৮০% WDG) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
২. মাঝারি আক্রমণে:
- ট্রাইফ্লক্সিস্ট্রোবিন + টেবুকোনাজল (নাটিভো ৭৫ WG) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
৩. তীব্র আক্রমণে:
- প্রোপিকোনাজল (টিল্ট ২৫০ EC) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
- ডিফেনকোনাজল (স্কোর ২৫০ EC) প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
জৈবিক নিয়ন্ত্রণ
১. নিম সমাধান: ১ কেজি নিম পাতা ১০ লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে সেই পানি স্প্রে করা।
২. দুধের দ্রবণ: ১ লিটার পানিতে ১০০ মিলি দুধ মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করা।
৩. ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি: প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম ট্রাইকোডার্মা মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর স্প্রে করা।
বিশেষ সতর্কতা
১. সরিষা গাছে ফুল আসার আগেই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
২. একই ছত্রাকনাশক বারবার ব্যবহার না করে পরিবর্তন করে ব্যবহার করা উচিত।
৩. ছত্রাকনাশক স্প্রে করার সময় সকাল বেলা বা বিকাল বেলা করা উত্তম, দুপুরে করা উচিত নয়।
৪. যে কোনো ছত্রাকনাশক ব্যবহারের সময় নিরাপত্তামূলক পোশাক পরিধান করুন এবং সুরক্ষা বজায় রাখুন।
সঠিক সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতিতে উপরোক্ত প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সরিষার পাউডারি মিলডিউ রোগ থেকে ফসলকে রক্ষা করা সম্ভব, যা ফলন ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।