অল্টারনারিয়া পাতায় দাগ রোগ সরিষা ফসলে এর লক্ষণ ও প্রতিকার
Open Calculator
অল্টারনারিয়া পাতায় দাগ রোগ: সরিষা ফসলে এর লক্ষণ ও প্রতিকার
অল্টারনারিয়া পাতায় দাগ রোগ (Alternaria leaf spot disease) সরিষার একটি মারাত্মক ছত্রাকজনিত রোগ, যা সারা বাংলাদেশে সরিষা চাষে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে থাকে। আসুন এই রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক।
রোগের কারণ
এই রোগ মূলত অল্টারনারিয়া ব্রাসিকি (Alternaria brassicae) এবং অল্টারনারিয়া ব্রাসিসিকোলা (Alternaria brassicicola) নামক ছত্রাকের কারণে হয়ে থাকে। এই ছত্রাকগুলো বিশেষ করে আর্দ্র ও গরম আবহাওয়ায় দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
সময়কাল
এই রোগ সাধারণত সরিষা ফসলের নিম্নলিখিত সময়ে বেশি দেখা যায়:
- ফসল বৃদ্ধি পর্যায়ে (১০-১২ সপ্তাহ বয়সে)
- ফুল আসার সময়
- ফল ধরার সময়
- বিশেষ করে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে (বাংলাদেশে) যখন সকালে কুয়াশা ও মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়
রোগের লক্ষণসমূহ
১. পাতায় দাগ: প্রথমে পাতায় ছোট ছোট গোলাকার বা অনিয়মিত আকৃতির বাদামী দাগ দেখা যায়। এই দাগগুলো ক্রমে বড় হয়ে কালো বর্ণের হয়ে যায়। দাগের মধ্যভাগ ধূসর বা হালকা বাদামী বর্ণের হয় এবং চারপাশে গাঢ় বাদামী বা কালো প্রান্ত থাকে।
২. কেন্দ্রিক দাগ: দাগগুলো কেন্দ্রিক আকারে বিকশিত হয় - মানে একটি দাগের চারপাশে আরও ছোট দাগ সৃষ্টি হয়।
৩. পাতার ক্ষতি: আক্রান্ত পাতা ক্রমে হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায় এবং ঝরে পড়ে।
৪. কান্ডে আক্রমণ: পাতা ছাড়াও কান্ডেও কালো বা বাদামী দাগ দেখা যায়।
৫. শিম বা ফলে দাগ: ফলে বা শিমে গোল বা অনিয়মিত আকৃতির কালো দাগ দেখা যায়। গাছের অন্যান্য অংশের তুলনায় শিমে এই রোগের আক্রমণ বেশি মারাত্মক হয়।
৬. বীজে আক্রমণ: রোগ শিম থেকে বীজে ছড়ায়। আক্রান্ত বীজ সংকুচিত ও দাগযুক্ত হয়।
অনুকূল পরিবেশ
- তাপমাত্রা: ২০-৩০°C
- আপেক্ষিক আর্দ্রতা: ৮০% বা তার বেশি
- আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকা
- হালকা বৃষ্টি বা কুয়াশা
আক্রমণের মাত্রা
- হালকা আক্রমণে ফলন ৫-১০% কমে যায়
- মাঝারি আক্রমণে ফলন ২০-৩০% কমে যায়
- মারাত্মক আক্রমণে ফলন ৪০-৫০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে
প্রতিকার ব্যবস্থা
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
১. সুস্থ বীজ ব্যবহার: রোগমুক্ত উৎস থেকে বীজ সংগ্রহ করুন।
২. বীজ শোধন: বপনের আগে বীজ শোধন করুন। প্রতি কেজি বীজে ২-৩ গ্রাম ক্যাপটান বা থিরাম দিয়ে বীজ শোধন করা যেতে পারে।
৩. ফসল পর্যায়ক্রম: একই জমিতে বার বার সরিষা চাষ না করে ফসল পর্যায়ক্রম অনুসরণ করুন। সরিষার পর ধান বা গম চাষ করুন।
৪. সুষম সার প্রয়োগ: মাটিতে পটাশ জাতীয় সার পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রয়োগ করুন।
৫. রোগ প্রতিরোধী জাত: রোগ প্রতিরোধী জাত যেমন - BARI Sarisha-11, BARI Sarisha-16 ইত্যাদি ব্যবহার করুন।
৬. আক্রান্ত উদ্ভিদাংশ অপসারণ: আক্রান্ত পাতা, কান্ড ও অন্যান্য অংশ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলুন।
৭. সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ: গাছের মধ্যে উপযুক্ত দূরত্ব বজায় রাখুন যাতে বাতাস চলাচল করতে পারে।
রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ
রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে নিম্নলিখিত ছত্রাকনাশক স্প্রে করা যেতে পারে:
১. ম্যানকোজেব: ২.০-২.৫ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করুন।
২. ইপ্রোডিওন: ১.০ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন।
৩. ডাইথেন এম-৪৫: ২.০ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন।
৪. রোভরাল: ২.০ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন।
৫. কপার অক্সিক্লোরাইড: ৩.০ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন।
মনে রাখবেন:
- প্রথম স্প্রের ৭-১০ দিন পর আবার স্প্রে করুন
- মোট ২-৩ বার স্প্রে করা যেতে পারে
- ফসল সংগ্রহের ১৫-২০ দিন আগে স্প্রে করা বন্ধ করুন
জৈবিক নিয়ন্ত্রণ
১. নিমের সত্ত: ৫০ গ্রাম নিম পাতা ১ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে সেই পানি স্প্রে করুন।
২. ট্রাইকোডার্মা হারজিয়ানাম: এই ছত্রাক বীজ শোধনে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩. সরিষার খৈল: জমিতে শেষ চাষের সময় হেক্টর প্রতি ২.৫-৩.০ টন সরিষার খৈল প্রয়োগ করা যেতে পারে।
অল্টারনারিয়া পাতায় দাগ রোগ সনাক্ত করার পর দ্রুত প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ফসলের ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (আইপিএম) অনুসরণ করে এই রোগ দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।