জাব পোকা আক্রমণের সময়, লক্ষণ এবং দমন পদ্ধতি
Open Calculator
জাব পোকা: আক্রমণের সময়, লক্ষণ এবং দমন পদ্ধতি
জাব পোকা বা এফিড বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ। এই ছোট আকারের পোকাটি বিভিন্ন ফসলে আক্রমণ করে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করে। আসুন জাব পোকা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।
জাব পোকা বেশি দেখা যায় যে সময়ে
জাব পোকা মূলত নিম্নলিখিত সময়ে বেশি দেখা যায়:
- মৌসুম অনুযায়ী: শীতকাল থেকে বসন্ত এবং গ্রীষ্মের শুরুতে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত) জাব পোকার প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।
- তাপমাত্রার প্রভাব: মাঝারি তাপমাত্রা (২০-২৮°C) জাব পোকার বংশবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত। অত্যধিক গরম বা ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় এদের সংখ্যা কমে যায়।
- আর্দ্রতা: মাঝারি আর্দ্রতা (৬০-৭০%) এদের বৃদ্ধির জন্য অনুকূল।
- শুষ্ক আবহাওয়া: বৃষ্টিহীন শুষ্ক মৌসুমে এদের আক্রমণ বেশি হয়।
- ফসলের অবস্থা: নতুন কচি পাতা, কুঁড়ি এবং নরম কাণ্ডযুক্ত গাছে এদের আক্রমণ বেশি হয়।
জাব পোকার আক্রমণের লক্ষণ
জাব পোকার আক্রমণের প্রধান লক্ষণগুলি হল:
- পাতা কুঁচকে যাওয়া: আক্রান্ত গাছের পাতা কুঁচকে যায় এবং উপরের দিকে বেঁকে যায়।
- বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া: গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং কচি অংশ বিকৃত হয়ে যায়।
- রস শোষণ: জাব পোকা গাছের রস শোষণ করে, যার ফলে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে।
- মধুর আবরণ: জাব পোকা মধু জাতীয় পদার্থ নিঃসরণ করে, যার উপর কালো ছত্রাক জন্মে ("সুটি মোল্ড")।
- পাতায় হলুদ বা লালচে ছোপ: আক্রান্ত পাতায় বিভিন্ন ধরনের বর্ণের ছোপ দেখা যায়।
- পোকার উপস্থিতি: গাছের নিচের দিকে এবং পাতার নীচে সবুজ, হলুদ, কালো বা ধূসর রঙের ছোট পোকা দেখা যায়।
- ভাইরাস সংক্রমণ: জাব পোকা বিভিন্ন ভাইরাস রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে, যেমন মোজাইক ভাইরাস বা পাতা কুঁচকানো ভাইরাস।
জাব পোকা দমন পদ্ধতি
জাব পোকা দমনের জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলি অনুসরণ করা যেতে পারে:
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM)
- পর্যবেক্ষণ: নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রাথমিক অবস্থায় জাব পোকার আক্রমণ শনাক্ত করা।
- পরজীবী এবং শিকারী পোকা: লেডিবার্ড বিটল, সিরফিড ফ্লাই, প্যারাসিটিক ওয়াস্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক শত্রুদের সংরক্ষণ করা।
জৈবিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
- নিম সমাধান: ৫% নিম বীজের আর্ক বা নিম তেল (৫ মিলি/লিটার পানি) স্প্রে করা।
- সাবান পানির দ্রবণ: ২-৩% সাবান দ্রবণ স্প্রে করা (২০-৩০ গ্রাম সাবান/লিটার পানি)।
- রসুন দ্রবণ: ৫০ গ্রাম রসুন + ২৫ গ্রাম আদা + ২৫ গ্রাম লঙ্কা পিষে ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা।
- তামাকের গুঁড়া: ৫০ গ্রাম তামাকের গুঁড়া ১ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে স্প্রে করা।
রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ
- সিস্টেমিক কীটনাশক: ইমিডাক্লোপ্রিড (০.৫ মিলি/লিটার), থায়ামেথক্সাম (০.৩ গ্রাম/লিটার), ডাইমেথোয়েট (২ মিলি/লিটার) ইত্যাদি ব্যবহার করা।
- পাইরেথ্রয়েড কীটনাশক: সাইপারমেথ্রিন (১ মিলি/লিটার), ফেনভালারেট (১-২ মিলি/লিটার) ইত্যাদি প্রয়োগ করা।
আগাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
- সঠিক ফসল পর্যায় অনুসরণ: পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ফসল চাষ করা।
- আগাছা পরিষ্কার: জমি থেকে আগাছা পরিষ্কার করা, যেগুলি জাব পোকার আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।
- সুষম সার প্রয়োগ: অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার ব্যবহার না করা, যা জাব পোকার বংশবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে।
- সময়মত রোপণ: এমন সময়ে ফসল রোপণ করা যখন জাব পোকার প্রাদুর্ভাব কম থাকে।
- প্রতিরোধী জাত: জাব পোকা প্রতিরোধী ফসলের জাত ব্যবহার করা।
- আলোক ফাঁদ: হলুদ আঠালো ফাঁদ (Yellow Sticky Trap) ব্যবহার করা।
- পানি সিঞ্চন: নিয়মিত পানি সিঞ্চন করে জাব পোকা ধুয়ে ফেলা।
মনে রাখতে হবে, জাব পোকা দমনের জন্য সমন্বিত পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর। প্রথমে জৈবিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত। রাসায়নিক কীটনাশক শেষ উপায় হিসেবে ব্যবহার করা উচিত, কারণ এটি প্রাকৃতিক শত্রুদের ক্ষতি করে এবং পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।