সরিষা ফসলে থ্রিপস পোকা সময়, লক্ষণ ও দমন পদ্ধতি
Open Calculator
সরিষা ফসলে থ্রিপস পোকা: সময়, লক্ষণ ও দমন পদ্ধতি
ভূমিকা:
সরিষা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান তেল জাতীয় ফসল। তবে, সরিষা চাষে নানা ধরনের পোকামাকড় আক্রমণ করে থাকে, যার মধ্যে থ্রিপস পোকা (Thrips) একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর কীট। এটি ফসলের উৎপাদন ও গুণগত মানে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সঠিক সময়ে এ পোকাটিকে চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
থ্রিপস পোকা কোন সময় বেশি দেখা দেয়:
থ্রিপস পোকা সাধারণত শুষ্ক ও উষ্ণ আবহাওয়ায় বেশি সক্রিয় থাকে। সরিষা ফসলে এটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে, বিশেষ করে শীতকালে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে।
- ফুল আসার সময় (budding to flowering stage) এ পোকাটি সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করে, কারণ এই সময় থ্রিপসের জন্য ফুলের রস বিশেষভাবে আকর্ষণীয়।
- আর্দ্রতা কমে গেলে, যেমন কুয়াশার পরে উজ্জ্বল সূর্য ওঠে—এমন পরিস্থিতিতে থ্রিপসের আক্রমণ বেড়ে যায়।
থ্রিপস পোকার আক্রমণের লক্ষণ:
থ্রিপস পোকা আকারে খুবই ছোট (১-২ মিমি), চোখে ধরা পড়া কঠিন। কিন্তু এর আক্রমণের কারণে নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায়:
- পাতার রঙ পরিবর্তন: পাতা সাদা বা রূপালি দাগ পড়া শুরু করে। পাতার কিনারায় বাদামি হয়ে শুকিয়ে যেতে পারে।
- পাতার আকৃতি বদলে যায়: পাতা কুঁচকে যায় ও মোচড়ায় যায়।
- ফুল ও কুঁড়ির ক্ষতি: কুঁড়ি ও ফুল বিকশিত হতে না পারা বা বিকলাঙ্গ হওয়া।
- ফসলের গঠন খারাপ: সরিষার গুটি ভালোভাবে বিকশিত হয় না, ফলে দানা কম হয় ও ফলন কমে।
- পাতার নিচে বা ফুলে পোকা: মাইক্রোস্কোপিকভাবে বা ভালো করে তাকালে পাতার নিচে বা ফুলের ভেতরে ছোট বাদামি বা কালচে পোকা দেখা যায়।
থ্রিপস পোকার দমন প্রক্রিয়া:
থ্রিপস পোকা দমনের জন্য সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) পদ্ধতি অনুসরণ করাই সবচেয়ে কার্যকর। নিচে কয়েকটি কার্যকর পদ্ধতি দেওয়া হলো:
✅ ১. কৃষি ব্যবস্থা (Cultural Control):
- সঠিক সময়ে বপন: নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বপন করলে থ্রিপসের আক্রমণ অপেক্ষাকৃত কম হয়।
- পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ: আগাছা ও আগের মৌসুমের ফসলের অবশিষ্টাংশ সরিয়ে ফেললে পোকা বংশবৃদ্ধি করতে পারে না।
- ফাঁদ ব্যবহার: হলুদ রঙের স্টিকি ট্র্যাপ (yellow sticky trap) ব্যবহার করে থ্রিপস মনিটর ও আংশিক নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
✅ ২. যান্ত্রিক ও হাত দিয়ে দমন:
- আক্রমণ বেশি হলে আক্রান্ত গাছ বা শাখা অপসারণ করে ধ্বংস করা যেতে পারে।
✅ ৩. জৈব নিয়ন্ত্রণ (Biological Control):
- পরজীবী ও শিকারি পোকা: যেমন Orius spp., Chrysoperla spp. ইত্যাদি প্রাকৃতিক শত্রু হিসেবে থ্রিপস দমন করতে সাহায্য করে।
- নীম তেল স্প্রে: ২-৩ মিলি/লিটার হারে নীম তেল প্রয়োগ করা হলে পোকা দমন হয় এবং পরিবেশবান্ধবও।
✅ ৪. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ (Chemical Control):
প্রয়োজনে নিচের কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে (গবেষণা/পরামর্শ অনুযায়ী ডোজ অনুসরণ করে):
কীটনাশকের নাম
|
ডোজ
|
প্রয়োগের সময়
|
ইমিডাক্লোপ্রিড (Imidacloprid 17.8% SL)
|
১ মি.লি./লিটার পানি
|
আক্রমণ শুরু হলে
|
স্পিনোসাড (Spinosad 45% SC)
|
১.৫ মি.লি./লিটার
|
ফুল আসার আগেই
|
থায়োমেথক্সাম (Thiamethoxam 25 WG)
|
০.৩ গ্রাম/লিটার
|
১০–১৫ দিন পরপর ২ বার
|
মনে রাখবেন: বারবার একই কীটনাশক ব্যবহারে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। তাই রোটেশন করে ব্যবহার করা উচিত।
উপসংহার:
থ্রিপস পোকা ছোট হলেও এর ক্ষতি ভয়াবহ হতে পারে, বিশেষ করে ফুলের সময় এর আক্রমণ ফসলের গুণগত ও পরিমাণগত ক্ষতি করে। তাই নিয়মিত মাঠ পর্যবেক্ষণ, আগাম সতর্কতা এবং সঠিক দমন পদ্ধতি অনুসরণ করলেই থ্রিপসের ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষি চর্চার মাধ্যমে সরিষা ফসলের স্বাস্থ্য ভালো রাখা সম্ভব।