সরিষা ফসলে মাইট বা মাকড়ের আক্রমণ সময়, লক্ষণ ও দমন ব্যবস্থা
Open Calculator
সরিষা ফসলে মাইট বা মাকড়ের আক্রমণ: সময়, লক্ষণ ও দমন ব্যবস্থা
ভূমিকা
সরিষা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ তেলজাতীয় ফসল। তবে এর উৎপাদনে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে অন্যতম ক্ষতিকর কীট হলো মাইট বা মাকড়। এটি ক্ষুদ্রাকৃতির এক ধরনের পরজীবী, যা গোপনে গাছের রস শোষণ করে ফসলের ক্ষতি করে। সময়মতো মাকড় সনাক্ত না করা গেলে ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যেতে পারে।
মাইট বা মাকড় কী?
মাকড় (Mite) একধরনের অতি ক্ষুদ্র আর্থোপড, যা সাধারণত পাতা ও কচি ডগায় বাস করে এবং গাছের রস শোষণ করে। এরা চোখে দেখা কঠিন হলেও ক্ষতির চিহ্ন দেখে সহজেই সনাক্ত করা যায়।
মাইটের আক্রমণের সময়
মাকড় সাধারণত শুষ্ক ও উষ্ণ আবহাওয়ায় বেশি দেখা যায়।
নির্দিষ্ট সময়কাল:
- নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে, যখন আবহাওয়া শুষ্ক ও হালকা গরম থাকে।
- বৃষ্টিপাত কম হলে এবং মাটির আর্দ্রতা কমে গেলে মাকড় দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে।
- সকাল বেলার শিশির বা কুয়াশা মাকড়ের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে।
মাইটের আক্রমণের লক্ষণ
মাকড়ের আক্রমণে গাছের বিভিন্ন অংশে নিচের লক্ষণগুলো দেখা যায়:
- পাতার রং পরিবর্তন – প্রথমে পাতায় হালকা হলুদ বা বাদামি রঙের দাগ পড়ে। পরে তা শুকিয়ে যেতে থাকে।
- পাতা কুঁকড়ে যাওয়া – পাতার গঠন অস্বাভাবিক হয়ে যায় এবং পাতাগুলো কুঁচকে যায়।
- পাতার নিচে জালের মতো আবরণ – অনেক সময় পাতার নিচের দিকে মাকড় জাল তৈরি করে।
- ফুল ও ফলের ক্ষতি – কুঁড়ি ঝরে যেতে পারে এবং ফল তৈরি হলেও তা অস্বাভাবিক হয়।
- গাছ দুর্বল হয়ে যায় – গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।
দমন পদ্ধতি
ক) কৌশলগত দমন (Cultural Control):
- ফসলের ঘনত্ব কমানো – খুব ঘনবসতি হলে বাতাস চলাচল কমে, যা মাকড়ের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।
- পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ – আগাছা ও আগের মৌসুমের অবশিষ্টাংশ পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
- ফসল ঘুরিয়ে চাষ – এক জমিতে বারবার সরিষা না চাষ করে অন্যান্য ফসলের সঙ্গে পালাক্রমে চাষ করলে মাকড়ের প্রভাব কমে।
খ) জৈব দমন (Biological Control):
- শত্রু কীট ব্যবহার – যেমন, Phytoseiulus persimilis নামক শিকারি মাইট ব্যবহার করে মাকড় দমন করা যায়।
- Neem oil (নীম তেল) স্প্রে করলে মাকড় দমনে কার্যকর হতে পারে।
গ) রাসায়নিক দমন (Chemical Control):
যদি আক্রমণ মারাত্মক হয় তবে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। তবে তা ব্যবহার করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
প্রস্তাবিত কীটনাশক:
- Sulphur 80% WP – প্রতি লিটার পানিতে ২-২.৫ গ্রাম হারে স্প্রে।
- Propargite 57% EC (যেমন Omite) – প্রতি লিটার পানিতে ১-১.৫ মি.লি.।
- Abamectin 1.8% EC – ০.৫ মি.লি./লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।
সতর্কতা:
- স্প্রে করার সময় হাতমোজা, মুখোশ ও চোখরক্ষা চশমা ব্যবহার করুন।
- সকাল ৯টার আগে বা বিকেল ৪টার পরে স্প্রে করাই উত্তম।
- মৌমাছি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কীটনাশক এড়িয়ে চলুন।
উপসংহার
সরিষা ফসলে মাকড় বা মাইটের আক্রমণ সময়মতো না চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে উৎপাদনে বড় ক্ষতি হয়। শুষ্ক ও উষ্ণ মৌসুমে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে চাষ পদ্ধতির উন্নয়ন, জৈব উপায় প্রয়োগ এবং প্রয়োজনে রাসায়নিক কীটনাশকের সাহায্যে এর কার্যকর দমন সম্ভব। কৃষকদের উচিত নিয়মিত মাঠ পর্যবেক্ষণ করা এবং সঠিক সময়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে সরিষা ফসলের উৎপাদন ও গুণগত মান বজায় থাকে।