সরিষায় সাদা মাছি আক্রমণের সময়, লক্ষণ ও দমন পদ্ধতি
Open Calculator
সরিষায় সাদা মাছি: আক্রমণের সময়, লক্ষণ ও দমন পদ্ধতি
ভূমিকা
সরিষা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ তেলজাতীয় ফসল। তবে এই ফসল নানা ধরনের পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের মধ্যে সাদা মাছি (Whitefly) একটি মারাত্মক কীট, যা সরিষা গাছের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। সাদা মাছির আক্রমণে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে, ফুল ও ফলন কমে যায় এবং ভাইরাসজাত রোগের বিস্তার ঘটে। তাই এর সময়মতো নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
সাদা মাছি কী?
সাদা মাছি (বৈজ্ঞানিক নাম: Bemisia tabaci) একটি ছোট আকারের, ডানাবিশিষ্ট, হালকা সাদা রঙের কীট। এটি সাধারণত পাতার নিচে বসে রস শোষণ করে এবং এর মাধ্যমে বিভিন্ন ভাইরাস ছড়ায়।
সাদা মাছির আক্রমণের সময়
সাদা মাছির আক্রমণ মূলত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে সাধারণত:
- অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাসে সরিষা চাষ হয়ে থাকে।
- সাদা মাছি নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বেশি দেখা যায়, বিশেষ করে যখন তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে হালকা ও আর্দ্রতা বেশি থাকে (২৫–৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস)।
- রৌদ্রজ্জ্বল এবং হালকা ঠান্ডা আবহাওয়ায় এদের আক্রমণ বেশি হয়।
সাদা মাছির আক্রমণের লক্ষণ
সাদা মাছির আক্রমণ শনাক্ত করার জন্য নিচের লক্ষণগুলো লক্ষ্য করতে হয়:
- পাতা কুঁচকে যাওয়া ও হলুদাভ হয়ে যাওয়া
মাছি পাতার নিচের দিক থেকে রস শোষণ করে, ফলে পাতার রঙ হালকা হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত শুকিয়ে পড়ে।
- মধুরস নিঃসরণ
মাছির মুখাংশ থেকে নির্গত মধুরস পাতার ওপর জমে থাকে, যা কালী ফাংগাস (sooty mold) তৈরি করে। এতে পাতার ফটোসিন্থেসিস বাধাগ্রস্ত হয়।
- ফুল ও ফলন হ্রাস
ফুল পড়তে থাকে এবং ফল তৈরি হলেও আকার ছোট হয়, যা ফলন কমিয়ে দেয়।
- ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে
সাদা মাছি Yellow Vein Mosaic Virus ও অন্যান্য ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারে, যা গাছকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করে তুলতে পারে।
সাদা মাছি দমন পদ্ধতি
সাদা মাছি দমনের জন্য সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা (IPM) অনুসরণ করা উত্তম। নিচে কয়েকটি কার্যকরী দমন কৌশল উল্লেখ করা হলো:
✅ ১. আগাম সতর্কতা ও পরিবেশগত ব্যবস্থা:
- রোগ প্রতিরোধী জাত নির্বাচন করা।
- জমির আশেপাশের আগাছা পরিষ্কার রাখা, যেগুলো সাদা মাছির আবাসস্থল হতে পারে।
- জমিতে হলুদ রঙের আঠালো ফাঁদ (Yellow sticky trap) ব্যবহার করা — এটি সাদা মাছি আকৃষ্ট করে ও আটকায়।
✅ ২. যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ:
- আক্রান্ত পাতাগুলো ছেঁটে ফেলা ও ধ্বংস করা।
- হাত দিয়ে পোকা ধরা (যদি আক্রমণ কম হয়)।
✅ ৩. জৈব বা প্রাকৃতিক উপায়:
- নিমবীজ বা নিমতেল স্প্রে (Neem oil or Azadirachtin 1%) ব্যবহার করা যায়। এটি পরিবেশবান্ধব ও কার্যকর।
- রসুন, লঙ্কা ও নিমপাতা দিয়ে তৈরি প্রাকৃতিক কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে।
✅ ৪. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ (শেষ ব্যবস্থা):
যখন আক্রমণ বেশি হয়, তখন কীটনাশক প্রয়োগ করা দরকার। তবে তা অবশ্যই সঠিক মাত্রায় ও নির্দেশনা অনুসারে দিতে হবে।
- ইমিডাক্লোপ্রিড (Imidacloprid 17.8% SL) – ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে।
- থায়ামেথক্সাম (Thiamethoxam 25% WG) – ১ গ্রাম প্রতি ৩ লিটার পানিতে।
- অ্যাসেটামিপ্রিড (Acetamiprid 20% SP) – ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে।
দ্রষ্টব্য: রাসায়নিক ব্যবহারের পর নিরাপদ ব্যবধান (pre-harvest interval) বজায় রাখা জরুরি।
উপসংহার
সরিষা ফসলের উৎপাদনশীলতা রক্ষা ও গুণগত মান নিশ্চিত করতে হলে সাদা মাছির আক্রমণ প্রতিরোধে সময়মতো ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। সচেতন চাষি হিসেবে নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ, পরিবেশবান্ধব দমন কৌশল প্রয়োগ এবং প্রয়োজনে রাসায়নিক ব্যবহার করলে সাদা মাছির ক্ষতি অনেকটাই রোধ করা সম্ভব।