সরিষা চাষে রোগসমূহ এবং তাদের প্রতিকার
Open Calculator
সরিষা চাষে রোগসমূহ এবং তাদের প্রতিকার
সরিষা বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশগুলিতে একটি প্রধান অর্থকরী ফসল। এটি মূল্যবান খাদ্য তেল উৎপাদন করে যা দৈনন্দিন রান্নায় ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সরিষা চাষের সময় বিভিন্ন রোগ এর উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিতে পারে। আসুন সরিষার প্রধান রোগগুলি এবং তাদের প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।
সরিষার প্রধান রোগসমূহ
১. অল্টারনারিয়া পাতা দাগ রোগ (Alternaria Leaf Spot)
লক্ষণ:
- পাতায় বাদামি থেকে কালো রঙের গোলাকার দাগ পড়ে
- এই দাগগুলি ক্রমশ বড় হয়ে পাতা নষ্ট করে ফেলে
- গুরুতর আক্রমণে পাতা শুকিয়ে যায়
- বীজে কালো দাগ দেখা যায়
কারণ: অল্টারনারিয়া ব্রাসিকি নামক ছত্রাক
প্রতিকার:
- ৩ গ্রাম রোভরাল বা ২ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন অন্তর স্প্রে করুন
- আক্রান্ত পাতা ও গাছের অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলুন
- রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করুন
- ৩ বছরের ফসল পর্যায়ক্রম (ক্রপ রোটেশন) অনুসরণ করুন
২. শ্বেত মরিচা বা সাদা মরিচা (White Rust)
লক্ষণ:
- পাতার নিচের দিকে সাদা বা ক্রিম রঙের ফোস্কা বা পাস্টিউল দেখা যায়
- উপরের দিকে হলুদ দাগ দেখা দেয়
- ফুলের অংশ বিকৃত হয়ে "স্টাগহেড" (হরিণের শিংয়ের মত) আকৃতি ধারণ করে
- ফুল ও বীজের উৎপাদন কমে যায়
কারণ: অ্যালবুগো ক্যান্ডিডা (Albugo candida) নামক ছত্রাক
প্রতিকার:
- রাইডোমিল গোল্ড (২ গ্রাম/লিটার) বা ডাইথেন এম-৪৫ (২.৫ গ্রাম/লিটার) স্প্রে করুন
- আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলুন
- রোগ প্রতিরোধী জাত যেমন BSH-1, BARI Sarisha-11 ইত্যাদি ব্যবহার করুন
- সময়মত বীজ বপন করুন (কার্তিক মাসের শেষ থেকে অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি)
৩. ডাউনি মিলডিউ (Downy Mildew)
লক্ষণ:
- পাতার উপরিভাগে হলদে দাগ দেখা যায়
- পাতার নিচের দিকে ধূসর বা বাদামি ছাতাপোকার আবরণের মত দেখা যায়
- পাতা ক্রমশঃ শুকিয়ে যায়
- গুরুতর আক্রমণে চারা গাছ মারা যায়
কারণ: পেরোনোস্পোরা প্যারাসিটিকা (Peronospora parasitica) ছত্রাক
প্রতিকার:
- রিডোমিল গোল্ড (২ গ্রাম/লিটার পানিতে) বা ম্যানকোজেব (২.৫ গ্রাম/লিটার) ১০-১২ দিন অন্তর স্প্রে করুন
- জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখুন
- অতিরিক্ত আর্দ্রতা এড়িয়ে চলুন
- ৩-৪ বছরের ফসল পর্যায়ক্রম অনুসরণ করুন
৪. কান্ড পচা রোগ (Stem Rot)
লক্ষণ:
- গাছের গোড়ার অংশে বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়
- ক্রমশঃ গোটা কান্ড পচে যায়
- গাছ হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়
- গাছের ভিতরে সাদা তুলার মত মাইসেলিয়াম দেখা যায়
কারণ: স্ক্লেরোটিনিয়া স্ক্লেরোটিওরাম (Sclerotinia sclerotiorum) ছত্রাক
প্রতিকার:
- প্রভেক্স/ভিটাভেক্স (২.৫ গ্রাম/কেজি বীজ) দিয়ে বীজ শোধন করুন
- রোভরাল/কার্বেন্ডাজিম (২ গ্রাম/লিটার) স্প্রে করুন
- জমিতে পানি জমতে না দেওয়া
- সুষম সার প্রয়োগ করুন
- ফসল পর্যায়ক্রম অনুসরণ করুন
৫. পাউডারি মিলডিউ (Powdery Mildew)
লক্ষণ:
- পাতার উপরে সাদা গুঁড়ার মত আবরণ দেখা যায়
- পাতা পীতবর্ণ হয়ে শুকিয়ে যায়
- গুরুতর আক্রমণে ফুল ও ফল উৎপাদন কমে যায়
কারণ: এরিসিফি ক্রুসিফেরারাম (Erysiphe cruciferarum) ছত্রাক
প্রতিকার:
- সালফার যুক্ত ছত্রাকনাশক যেমন থিওভিট (২ গ্রাম/লিটার) স্প্রে করুন
- কেরাথেন বা ট্রাইডিমেফন (১ মিলি/লিটার) ১০-১২ দিন অন্তর স্প্রে করুন
- রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে প্রতিকারে নামুন
৬. ক্লাব রুট (Club Root)
লক্ষণ:
- শিকড়ে গিট বা ফোলা দেখা যায়
- গাছ বেঁটে হয়ে যায়
- পাতা হলদে হয়ে শুকিয়ে যায়
- গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সহজেই উপড়ে যায়
কারণ: প্লাসমোডিওফোরা ব্রাসিকি (Plasmodiophora brassicae) নামক প্রোটিস্ট
প্রতিকার:
- জমিতে চুন (কৃষি চুন) প্রয়োগ করে মাটির অম্লতা কমান (৪-৫ কেজি/শতক)
- আক্রান্ত গাছ সংগ্রহ করে ধ্বংস করুন
- ৫-৬ বছরের ফসল পর্যায়ক্রম অনুসরণ করুন
- জমিতে জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখুন
সরিষার রোগ প্রতিরোধের সাধারণ উপায়সমূহ
১. প্রতিরোধী জাত ব্যবহার
- BARI Sarisha-11, BARI Sarisha-15, BARI Sarisha-16 ইত্যাদি প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করুন
- স্থানীয় পরিবেশের সাথে খাপ খায় এমন জাত নির্বাচন করুন
২. পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ
- আক্রান্ত গাছ ও ফসলের অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলুন
- জমি পরিষ্কার রাখুন
- আগাছা নিয়ন্ত্রণ করুন, কারণ অনেক আগাছা রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে
৩. সঠিক ফসল পর্যায়ক্রম
- একই জমিতে ৩-৪ বছর পর্যন্ত সরিষা বা ক্রুসিফেরি পরিবারের অন্য ফসল (যেমন বাঁধাকপি, ফুলকপি) চাষ করবেন না
- ফসল পর্যায়ক্রমে ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করুন
৪. বীজ শোধন
- বপনের আগে বীজ অবশ্যই ছত্রাকনাশক দিয়ে শোধন করুন
- প্রভেক্স-২০০/ভিটাভেক্স (২.৫ গ্রাম/কেজি বীজ) দিয়ে বীজ শোধন করুন
৫. উপযুক্ত সময়ে বপন
- কার্তিক মাসের শেষ থেকে অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি সময়ে বীজ বপন করলে রোগের প্রকোপ কম হয়
- দেরিতে বীজ বপন করলে রোগের আক্রমণ বেশি হয়
৬. সুষম সার প্রয়োগ
- শুধু নাইট্রোজেন সার না দিয়ে পটাশ ও ফসফরাস সারও প্রয়োগ করুন
- জৈব সার প্রয়োগ করুন (৫-৭ টন/হেক্টর)
- বোরন ও সালফার যুক্ত সার প্রয়োগ করুন
৭. ছত্রাকনাশক প্রয়োগ
- রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে উপযুক্ত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করুন
- ৭-১০ দিন অন্তর অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করুন
- সঠিক মাত্রায় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করুন
উপসংহার
সরিষা চাষে রোগ নিয়ন্ত্রণ সর্বদা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শুরু করা উচিত। রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিলে ফসলের ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) পদ্ধতি অনুসরণ করে রাসায়নিক, জৈবিক ও কৃষি পদ্ধতিগত উপায়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ করলে টেকসই ফলন পাওয়া সম্ভব।