বীজ প্রস্তুতি ও বপন: সফল ফসলের প্রথম ধাপ
ভালো বীজ চিনতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার প্রতিবেশী কৃষক সালাম মিয়া প্রায়ই অভিযোগ করেন, "গত বছর আমি সস্তা বীজ কিনে ফলন কম পেয়েছি।" একজন দক্ষ কৃষক হিসেবে আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে ভালো বীজের লক্ষণগুলো:
-
আকার ও আকৃতি
-
সমান আকারের, পূর্ণাঙ্গ বীজ বেছে নিন
-
বিকৃত, ভাঙ্গা বা অসম্পূর্ণ বীজ এড়িয়ে চলুন
-
রং
-
চকচকে ও পরিষ্কার
-
বীজ পরিষ্কার, ময়লা বা ধূলিমুক্ত হওয়া উচিত
-
আবর্জনা, পাথর, বা অন্য ফসলের বীজ মিশ্রিত না হওয়া উচিত
-
অঙ্কুরোদগম হার
গ্রামের বুড়ো চাষী মতিন চাচা সবসময় বলতেন, "বীজ যাচাই করে দেখো বাপু, এটাই ফসলের ভাগ্য নির্ধারণ করে।" আমি নিজেও তার পরামর্শ মেনে চলি।
বীজের উৎস
বীজ সংগ্রহের জন্য বিশ্বস্ত উৎস বেছে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নলিখিত উৎস থেকে বীজ সংগ্রহ করতে পারেন:
-
সরকারি প্রতিষ্ঠান
-
বেসরকারি সংস্থা
-
প্রতিষ্ঠিত বীজ কোম্পানি
-
NGO প্রকল্প
-
নিজস্ব বীজ
ময়মনসিংহের কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন, "আমি BADC থেকে বীজ কিনি। দাম একটু বেশি হলেও, গুণমান নিশ্চিত থাকে। ফলন ১৫-২০% বেশি পাই।"
বীজ প্রস্তুতি পদ্ধতি
১. বীজ বাছাই
বাছাই করার জন্য সহজ পদ্ধতি:
-
একটি পাত্রে পানি নিন
-
বীজগুলো পানিতে ঢালুন
-
ভাসমান বীজগুলো সরিয়ে ফেলুন, এগুলো খারাপ বীজ
-
ডুবে যাওয়া বীজগুলো ভালো, এগুলো বপনের জন্য রাখুন
বীজের ওজন পরীক্ষা করে আমি প্রতিবার ২০-২৫% খারাপ বীজ বাদ দিয়ে থাকি। এতে লাভ কম হয় না, বরং বাড়ে, কারণ ফলন ভালো হয়।
২. বীজ শোধন
বীজ শোধন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি:
ছত্রাকনাশক দিয়ে শোধন:
-
প্রতি কেজি বীজের জন্য ২-৩ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০/প্রোভ্যাক্স/থিরাম ছত্রাকনাশক ব্যবহার করুন
-
বীজের সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন
-
২৪ ঘণ্টা ছায়ায় রেখে শুকিয়ে নিন
প্রাকৃতিক উপায়ে শোধন:
-
নিম পাতার রস (২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন)
-
গরম পানি (৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ১০ মিনিট)
-
লেবু পানি (১ লিটার পানিতে ৫০ মিলি লেবুর রস, ১০ মিনিট)
রাজশাহীর অর্গানিক চাষি আবুল কালাম আজাদ বলেন, "আমি নিম পাতার নির্যাস দিয়ে বীজ শোধন করি। এতে ৯০% রোগবালাই কমে যায় এবং রাসায়নিক ছত্রাকনাশকের খরচও বাঁচে।"
৩. বীজ অঙ্কুরোদগমের জন্য প্রস্তুতি
অনেক ফসলের বীজ বপনের আগে ভিজিয়ে নিলে অঙ্কুরোদগম দ্রুত হয়:
ধান:
-
১২-২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন
-
২৪-৩৬ ঘণ্টা ভেজা কাপড়ে মুড়ে রাখুন অঙ্কুর বের হওয়ার জন্য
-
অঙ্কুর না বের হলেও চলবে, কিন্তু ভিজানো জরুরি
দিনাজপুরের সফল কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, "আমি ধানের বীজ ভিজিয়ে অঙ্কুর বের করে তবেই বীজতলায় বপন করি। এতে ৯৮% বীজ গজায় এবং চারা সমানভাবে বাড়ে।"
৪. বীজের মাত্রা
প্রতি বিঘায় (৩৩ শতক) বিভিন্ন ফসলের বীজের মাত্রা:
ধান:
[কৃষক হাতে বীজ নিয়ে পরিমাপ করছেন এমন দৃশ্য দেখানো হবে]
কৃষক আব্দুর রহিম মিয়া বলেন, "অনেকেই ভয়ে বীজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। কিন্তু বেশি বীজ বপন করলে গাছের ঘনত্ব বেশি হয়, ফলে ভাল ফলন পাওয়া যায় না। সঠিক পরিমাণ বীজ ব্যবহার করাই উত্তম।"
বীজ বপন পদ্ধতি
১. বপনের সময়
বীজ বপনের সময় ফসলের ধরন অনুসারে ভিন্ন হয়:
ধান:
-
আউশ: মার্চ-এপ্রিল
-
আমন: জুলাই-আগস্ট
-
বোরো: নভেম্বর-ডিসেম্বর
সময়ের সাথে সাথে বপনের সময় পরিবর্তন হতে পারে। রংপুরের রফিক চাচা বলেন, "আগে আমরা আষাঢ় মাসে আমন ধান বপন করতাম, কিন্তু এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শ্রাবণ মাসে বপন করি।"
২. বপনের পদ্ধতি
ক. ছিটিয়ে বপন
এটি সবচেয়ে সহজ এবং পারম্পরিক পদ্ধতি। নিম্নলিখিত ফসলের জন্য উপযুক্ত:
পদ্ধতি:
-
জমি তৈরি করুন
-
বীজ সমানভাবে ছিটিয়ে দিন
-
হালকাভাবে চাষ দিয়ে বীজ মাটির সাথে মিশিয়ে দিন
-
মই টেনে সমতল করুন
সুবিধা-অসুবিধা: ✓ সহজ পদ্ধতি, কম শ্রম লাগে ✓ বড় এলাকায় দ্রুত বপন করা যায় ✗ বীজের পরিমাণ বেশি লাগে ✗ সারি বপনের চেয়ে ফলন কম হয়
মানিকগঞ্জের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, "আমার কাছে শ্রমিক সংকট থাকায় গমের জন্য ছিটিয়ে বপন করি। তবে যেখানে সম্ভব, সারিতে বপন করাই ভাল।"
খ. সারিতে বপন
এটি আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, অধিকাংশ ফসলের জন্য উপযুক্ত:
পদ্ধতি:
-
জমি ভালোভাবে তৈরি করুন
-
মাটিতে সারি টানুন (নির্দিষ্ট দূরত্বে)
-
বীজ সারিতে ফেলুন
-
মাটি দিয়ে ঢেকে দিন
বিভিন্ন ফসলের সারির দূরত্ব:
সুবিধা: ✓ নির্দিষ্ট দূরত্বে চারা জন্মায় ✓ সার প্রয়োগ সহজ হয় ✓ আগাছা দমন সহজ হয় ✓ ফলন বেশি হয়
দিনাজপুরের সফল কৃষক ইব্রাহিম আলী বলেন, "আমি সিড ড্রিল মেশিন দিয়ে গমের বীজ সারিতে বপন করি। এতে ৮-১০% ফলন বেশি পাই।"
ঘ. বীজতলা থেকে রোপণ
অনেক ফসলের জন্য আগে বীজতলায় চারা তৈরি করে পরে মূল জমিতে রোপণ করা হয়:
বীজতলা তৈরির পদ্ধতি:
-
উঁচু জমি নির্বাচন করুন
-
ভালোভাবে জমি তৈরি করুন
-
জৈব সার মিশিয়ে দিন
-
বেড তৈরি করুন (১.০ মিটার × আবশ্যক দৈর্ঘ্য)
-
বীজ বপন করুন
-
হালকা মাটি দিয়ে ঢেকে দিন
-
চাটাই/খড় দিয়ে ঢেকে দিন
রোপণের বয়স:
টাঙ্গাইলের মহিলা কৃষক রেহানা বেগম বলেন, "বীজতলা অবশ্যই উঁচু জায়গায় করতে হবে। আমি প্রতিবছর ছায়ায় বীজতলা করি এবং সেখান থেকে চারা তুলে প্রধান জমিতে রোপণ করি।"
গ্রীষ্মকালে বীজতলা রক্ষার উপায়
গ্রীষ্মকালে বীজতলা রক্ষা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নিম্নলিখিত উপায়ে বীজতলা রক্ষা করা যায়:
-
ছায়া প্রদান
-
পর্যাপ্ত সেচ
-
মাটি ঢেকে রাখা
-
পলিথিন ঘর
কুমিল্লার কৃষক বদিউল আলম শেয়ার করেন, "আমি পলিব্যাগে চারা তৈরি করি। এতে স্থান কম লাগে এবং চারা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
আজ আমরা জানলাম বীজ প্রস্তুতি ও বপন সম্পর্কে বিস্তারিত। মনে রাখবেন, ভালো বীজ নির্বাচন, সঠিক প্রস্তুতি এবং উপযুক্ত পদ্ধতিতে বপন করলে আপনার ফসলের ফলন ২০-৩০% বৃদ্ধি পাবে।
আমি আবারও বলছি, ভালো বীজ আধা ফসল নিশ্চিত করে। তাই বীজ নিয়ে কোনো সমস্যা হলে স্থান